নিজস্ব প্রতিবেদক:
কোলে পিঠে আদর যত্নে তিল তিল করে গড়ে তোলা ২৫ বছর বয়সের বুকের ধন ছেলে কাউসার বাগমারকে বাবা হয়ে নিজ হাতে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করবেন এমন চিন্তা কখনো করেননি বাবা রশিদ বাগমার। ছেলে নেশার জগতে গিয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় নিজ সন্তানকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে বাবা। বুধবার (৩ এপ্রিল) গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার জামালপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
লেখাপড়া শেষে দেশে কোন চাকরিবাকরি না পেয়ে সৌদি পাড়ি জমায় কাউসার বাগমার। চাকরির মেয়াদ শেষে বছর খানেক আগে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে শুরু হয় বেকার জীবন যাপন। এক পর্যায়ে মাদকসেবিদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে কাউসার। বেকার জীবনে মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে মা-বাবার শরণাপন্ন হয় কাউসার।
মাদক সেবনের টাকা না পেয়ে মা-বাবার সাথে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি করতো কাউসার। পাড়া প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে ধার নেয়া টাকার তাগাদায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন বাবা। কোন ক্রমেই পাওনাদারদের তাগাদা সামাল দিতে পারছিলেন না মা-বাবা।
মাদকের টাকার জন্য বাড়িতে ভাঙচুর ও বাবা-মাকে অত্যাচার ও নির্যাতন করা শুরু করে দেয় কাউসার। মাদকের টাকার জন্য বাবার নামে থাকা দুই কাঠা জমি বিক্রি করে নেশার জন্য টাকা দিতে বলে ছেলে কাউসার বাগমার।
নিহতের বড় ভাই আশরাফুল বলেন, কাউসার সারা রাত নেশার ঘোরে বাড়ির বাইরে থাকতো ও মাদক সেবন করতো।
কোন ভাবেই মাদক থেকে ফেরানো যাচ্ছিল না তাকে। মাদকের জন্য সব সময় মা-বাবার কাছ টাকা চাইত। টাকা না দিলে বাড়িতে ভাঙচুর ও মা বাবাকে গালিগালাজ করতো। কাউসারের এমন পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। জমি বিক্রি করে নেশার টাকা না দিলে বাবা মাকে হত্যার হুমকি দেয় সে।
এমন পরিস্থিতিতে বাবা রশিদ বাগমার সারা রাত কান্না করেন ছেলের মরণছোবল নেশার আসক্তের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে। ভোররাতে বাবার পাশের রুমে গভীর ঘুমে ছেলে কাউসার। হঠাৎই বাবা রশিদ বাগমার বাড়িতে থাকা কুড়াল নিয়ে ছেলের রুমে ঢুকে কোপাতে শুরু করেন আদরের ধন ছেলে কাউসারকে।
বাবার এমন কোপানিতে ছেলে বলতে থাকে, বাবা তুমি আমারে আর মাইরো না, আর কোপ দিওনা, আমি আর নেশার টাকা চাইমু না তোমাগো কাছে! আমি ভালা হইয়া যামু গা!
ছেলের আর্তনাদের এমন চিৎকারে ছেলের উপর বাবার কুড়াল দিয়ে কোপানি থেমে যায় মুহূর্তে। রক্তাক্ত ছেলেকে আপন কোলে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না করতে থাকেন বাবা নামের মানুষটি। কাঁদতে থাকেন আর বলতে থাকেন বাবা তুই আমার আদরের ধন, কলিজার মানিক। ততক্ষণে ছেলের নিথর দেহটি বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে চিরদিনের জন্য।
আশপাশ থেকে ছুটে আসা মানুষজন ছেলে হত্যাকারী বাবাকে বলতে থাকেন, আপনি পালিয়ে যান, পুলিশ আসবে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে, আপনার ফাঁসি হবে, কারোর কথাই শুনছে না বাবা, বাবা বলছেন, আমার বাবাডারে আমি অনেক ভালবাসি, আমার বাবাডারে ছাইড়া আমি কই যামু, অশান্তির সাগরে আছি, আমার আর বাইচা থাইকা লাভ নাই! আমার পোলারে আমি কোপাইয়া মাইরা ফালাইছি! আমার ফাঁসি অইবো, আর তো কিছু না, হউক, আমি এখন শান্তি, আমারে আর কেও কিছু কইতো না, তাগাদা দিতো না, আমি শান্তি হইয়া গেলাম! ছেলের লাশের কাছে বসে বাবার এমন কান্নার আহাজারিতে আশপাশের মানুষজনের চোখের পানি ছলছল করেছে।
এমন সময় পুলিশ হাজির,, ছেলের মৃত্যু শোকে বাবা হাউমাউ করে বলতে লাগলেন আমি আমার পোলারে মাইরা ফালাইছি নেশার টাকা জোগাড় কইড়া দিতে না পারায়, আমারে জেল দেন ফাঁসি দেন, আমারে থানায় লইয়া যান! ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা কুড়ালটি জব্দ করে পুলিশ। স্বেচ্ছায় পুলিশের সঙ্গে রওনা দেওয়ার সময় বাবা, ছেলের শরীর জড়িয়ে ধরে আবারও হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলতে লাগলেন, বাবা তোমারে আমি মারতে চাই নাই ! বাবা তোমারে আমি কথা দিয়া গেলাম, সরকারের আদালতে গিয়া আমি কমু আমার বাবাডার হত্যাকাণ্ডের বিনিময়ে হলেও যেন দেশে নেশা মাদকের রাজ্য যেন বন্ধ করে সরকার!
দেশের সব বাবা গো কইয়া যাইতাছি তোমরা মাদকের নেশা কইরো না, মাদকের নেশায় তোমগো মা বাবারা খুব কষ্ট পায়। সংসারের সব কিছু তছনছ হইয়া যায়! বাবা আমার খুব কষ্ট লাগতাছে, বাবা আমার বুকটা ছিড়া যাইতাছে তোমার লেইগা, বাবা তোমারে কই পামু আমি, তোমারে ছাড়া আমি জেলের মধ্যে কেমনে থাকমু একলা একলা? পুলিশের গাড়িতে উঠতে উঠতে বাবার এমন সব কলিজার হৃদয় কাঁপানো কথা উপস্থিত সবাইকে কাঁদিয়েছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ, এলাকাবাসী ও স্বজনরা সরকারের কাছে বাবা রশিদ বাগমারের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন।
